Sunday, 6 September 2015

হাতে একটা টাইম মেশিন নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। নাড়াচাড়া করছি। টাইম মেশিনটা ভাল। তবে মেরাযে যাবার মতো অতো ভাল না। নবী মেরাজে গিয়েছিলেন শুনি বোররাকে চড়ে। আর আমার হাতের টাইম মেশিন হচ্ছে একটা প্রাচীন সাহিত্যের বই। যেটা পড়ে হালকা পাতলা অতীত ভ্রমন করা যায়।
এই বড়জোর পাঁচশ হাজার বছর। এতে আরেকটা সুবিধা হচ্ছে ইফতারির আগে আগেই ফিরে আসা যায়।
বইটির একটি ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে - এই বইটির একজন পাঠক আমার বেশ প্রিয়। তিনিও এই বইটি পড়েছেন এবং খুশি হয়ে একটি ভূমিকা রচনা করেছেন। ভূমিকাটি আবার বইটিতে সংযোজন করে দেয়া হয়েছে। পাঠকটি আমার সমকালিন নন। অসমকালীন। এই অসমকালীন পাঠকের নাম হচ্ছে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আপনারা অনেকেই তাকে নামে চেনেন।
আমি তার স্বহস্তে রচিত ভূমিকাটি পড়লাম। মনে মনে আপ্লুত হলাম। উনি ভূমিকাটির নিচে তারিখ লিখেছেন ১/১২/৩৯ প্রায় ছিয়াত্তুর বছর আগে। এতে তার সেই ছিয়াত্তুর বছর পুর্বের হস্তলিপি আমার চোখের সামনে।
ভদ্রলোকের হাতের লেখা মেয়েলি তবে ভালোই লাগে খারাপ না। কবি কবি ভাব আছে একটা।
বর্তমানে আমাদের দেশের যে সমস্ত তরুন কবিরা কবিতা লিখছেন তাদের কবিতা সাধারনত আমার মাথার উপর দিয়ে যায়। কবিতা পড়ার পর কিছুক্ষনের জন্যে ভুলে যাই এখন কোন বেলা? সকাল সন্ধা রাত নাকি দূপুর? তাই সাধারনত আমি একটু প্রাচীন সাহিত্যের কাব্যগুলোতেই কবিতা খুঁজতে যাই। মেসি আর রোনালদো যতই ভালো খেলুক পেলে আর মেরাডোনার খেলা যেমন ক্ল্যাসিক তেমনি জীবনানন্দ বা রবীন্দ্রনাথে যে তৃপ্তিটা আনন্দটা পাই সেটা বর্তমান কবিদের কবিতায় পাইনা। কেউ বলতে পারেন নতুনকে গ্রহন করার মন আমার নেই। হতে পারে। আমি মেনে নেবো। প্রাচীন দোতলা একটি ভবনকে ভেঙে নতুন টিনশেড ঘর দেখতে আমার কম ভাল লাগে। যাই হোক। তর্ক থাক। এটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
আমার কাছে যেমন রবীন্দ্র, জীবনানন্দ। জয়দেব আর বিদ্যাপতি তাদের কাছে ঠিক তেমন ছিলেন। আর সেই প্রাচীন কবি জয়দেব আর বিদ্যাপতি পড়েছেন তাদের যেই পুর্বসূরিদের রচনা সেই কবিরা হলেন শ্রীধর, চৈতন্য, কাশীনাথ, কঙ্ক। যারা কেউ রচতা করেছেন কলিকা মঙ্গল, মনসা মঙ্গল, কেউ বা বিদ্যা-সুন্দর। এদের লেখা পড়ছি আর ভাবছি এরা আজকের ইয়ো ইয়ো হানি সিং এর সময়ে থাকলে কেমন হতো? মনে হচ্ছে আল্লায় যা করে ভালোর জন্যই করে।
আমি প্রাচীন বাঙলার সময়কে উল্লেখ করে আমার বিভিন্ন কবিতায় এক কাল্পনিক প্রেমিকার বিরহে ভুগি। আমার এই প্রাচীন বাঙলার সেই প্রেমিকা দেখতে কেমন ছিল সেটা আমার জানা নেই। তবে সে ঢ়াড়, হরিকেল, গৌড়, পুন্ড্র, সূক্ষ্ম, সমতট কোন এক অঞ্চলে যে ছিল সেটা নিশ্চিত। তাই এই বইটি পড়তে পড়তে আমি সেই প্রাচীন বঙ্গের সমাজে ঢুকে পরেছিলাম।
সেখানে এক রাজ্যের নাম গৌড়। সেই রাজ্যের এক সভাকবি নাম তার শ্রীধর। তিনি বিদ্যা আর সুন্দর নামের দুই চরিত্র নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। সেখানে তিনি বিদ্যার ছবি এঁকেছেন তার কবিতায়।
তিনি বলেছেন -

নবীন ঘনের পুঞ্জ যেন কেশভার।
ধরনী বিলোটায় সে লম্বিত অপার।।
বিদ্যার বদনশশী যেন অববান্ধা।
খঞ্জন জিনিয়া দুই নয়নের ছন্দা।।
উহার ললাট যেন আধশশীখন্ড।
অধর বান্ধুলী যেন মুখ রসভান্ড।।
দশন মুকুতা পাঁতি বাক্য মধুপান।
ভুরুভঙ্গে কামদেব ধনুর সমান।।
গ্রাবাখন্ড দেখি শঙ্খ জলধি প্রবেশ।
মদন-মোহন-বিদ্যা যৌবন বিশেষ।।
কহত মাধব ভাট স্বরুপ উহার।
শ্রুতি নাসা কুচযুগ কিরুপ আকার।।
কুচযুগ মধ্যদেশ কুহরের ছন্দ।
উরুযুগ নিতন্ব কেমন প্রবন্ধ।।
।। মাধব ভাট কথয়তি।।
একমন হই শুন কহি যুবরাজ।
শ্রবন গৃধিনী দেখি পাইলেক লাজ।।
ফাটিল তাল পয়োধর দেশ।
কমল-কলিকা জলে করিল প্রবেশ।।
সমুখে কমলনাসা যেন তিল ফুল।
এ রামকদলী ভূজ নিতন্ব বিপুল।।
দেখিয়াছি কুমারীর বাহু ভুজঙ্গ।
সুবর্ণ মৃনালবর পদ্মএ সুরঙ্গ।।
ক্ষীণ মাঝা দেখি সিংহ পাই উপহাস।
লজ্জায় করিল গিরি কোটরেতে বাস।।
রক্ত-পদ্মসম পদযুগ সুকোমল।
নবশশী জিনি পদ-নথ নিরমল।।
চরনে মল সাজে গমন লীলায়।
চলিতে চলএ যেন রাজহংস যায়।।

বর্ননা পড়ে আমি বাক রুদ্ধ। ফেসবুকের কল্যানে বাঙলার কিছু এনসিয়েন্ট ফোটো দেখেছি। আঠারো সালের মাঝামাঝি আর কিছু উনিশ শতকের গোড়ার। সেইসব ছবিতে বাঙলার যে কয়টা রমনী দেখেছি সবগুলোকেই ভিক্ষুকের মতো লেগেছে। এখন বিদ্যা-সুন্দর পড়ে পুরো চিত্রটাই পাল্টে গেলো। মনে একটু আশা জাগছে যে যাক সানিলিয়নেরো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে বেইল নাই।
পাঠক যারা ধৈর্য ধরে এই তলাবিহীন লেখাটা পড়েছেন তাদেরকে শাহবাগ পুরস্কার। অর্থাৎ শাহবাগের জ্যামে বসে থাকার অভিজ্ঞতার পুরস্কার। আর ভাল কথা। আমি নিজেও সমকালিন অকবি। সো কোন কিছু জানতে চাহিয়া আমাকে সনাতন করিবেন না।

- অনি।
০৪/০৭/১৫
সন্ধা- ৭:৪৯

No comments:

Post a Comment